ইরাক ভেঙে তিন টুকরা হতে চলেছে?মেজর জেনারেল মো. আব্দুর রশীদ (অব.)
Source LINK
সিরিয়ার পূর্বাঞ্চল ও ইরাকের পশ্চিমাঞ্চলে মরুভূমিতে বেড়ে ওঠা আল কায়েদাপন্থি সুন্নি জঙ্গি ইসলামিক স্টেট অব ইরাক ও লিভান্ট (কুর্দিরা) নিনেভাহ প্রদেশের রাজধানী মসুল শহর দখল করে সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। ইরাকের সরকারি সেনারা অনেকগুণ শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও হাজারখানেক মারদাঙ্গা জঙ্গির ভয়ে কোনো প্রতিরোধ না করে মার্কিনিদের দেওয়া ভারী ট্যাংক-আর্টিলারি জঙ্গিদের জন্য ফেলে রেখে উর্দি খুলে পালিয়ে গেল। ইরাকের দ্বিতীয় বৃৃহত্তম শহর মসুলে প্রায় ১৬ লাখ মানুষের বাস। জঙ্গি রোষানলের ভয়ে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ জীবন বাঁচাতে শহর ছেড়ে পালিয়েছে। শহরের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ভোল্টে ৪৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ ইরাকি ডিনার পেয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী জঙ্গিগোষ্ঠী হিসেবে রেকর্ড করল কুর্দিরা। ওসামা বিন লাদেনের বাজেট ছিল ৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের মতো। সেইসঙ্গে জেল ভেঙে জঙ্গিরা বের করে আনল সাদ্দাম অনুগত দুই হাজার ৫০০ সুপ্রশিক্ষিত সেনা অফিসার ও সৈন্যদের। একসঙ্গে অর্জন করল অর্থ, ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও প্রশিক্ষিত সৈনিক। সেইসঙ্গে যোগ হলো সুন্নিদের বিভিন্ন গোষ্ঠীপ্রধানদের আনুগত্য ও সমর্থন। তাই কোনো সময় নষ্ট না করেই বাগদাদের দিকে এগিয়ে চলল কুর্দিরা। দখল হতে থাকল তিরকিত, বেইজা তেল শোধনাগার, রামাদা শহর। বাগদাদের পশ্চিমের শহর ফাল্লুজা জানুয়ারি থেকে দখলে রেখেছিল জঙ্গিরা। উত্তর পশ্চিমের নিনেভাহ, পশ্চিমের আনবার ও সালাহেদ্দিন প্রদেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরসহ প্রায় ইরাকের এক-তৃতীয়াংশের বেশি এলাকার ওপর দখল ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে। উত্তরের কুর্দিরা অনেক আগেই তাদের স্বশাসন নিয়ে কুর্দি আঞ্চলিক সরকার (কেআরজি) দ্বারা ইরাকের অধীনে কুর্দিস্থান নামে শাসিত হচ্ছে। তুরস্ক ইরাকি কুর্দিস্থানের বড় অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও উন্নয়ন অংশীদার। কুর্দিদের তেলে তুরস্কসমৃদ্ধ এবং তুরস্কের বন্দরের সঙ্গে পাইপলাইনের মাধ্যমে কুর্দিরা তেল রপ্তানি করছে। কেআরজির প্রেসিডেন্ট মাসুদ বারজানি তুর্কি কুর্দির সঙ্গে তুরস্কের শান্তি প্রক্রিয়াতে সহায়তা করছে।
শিয়া-সুন্নি হানাহানির ফলে ইরাক সরকারের নিয়ন্ত্রণ ক্রমান্বয়ে শিথিল হয়ে যাচ্ছে। সুন্নি জঙ্গি মোকাবিলায় মালিকির সামরিক শক্তি কুলিয়ে উঠতে পারছে না। সুন্নি জঙ্গিদের আক্রমণ ঠেকাতে প্রধানমন্ত্রী মালিকির হাতে অতিরিক্ত সেনা ইউনিট নেই। কুর্দিস্থানের সেনাবাহিনীর সাহায্য ছাড়া কোনো তাৎক্ষণিক বিকল্প নেই। তেলসমৃৃৃদ্ধ কিরকুকের অধিকার নিয়ে সুন্নি ও কুর্দিদের বিরোধ অনেক পুরনো। কিরকুককে ইরাকের জেরুজালেম বলা হয়, কারণ শহরটির এক অংশ সুন্নিদের দখলে অপর অংশ কুর্দিদের দখলে। শিয়া-সুন্নির লড়াইয়ের ফাঁকে ইতিমধ্যে কুর্দি সেনাবাহিনী কিরকুক নিজ দখলে নিয়ে তার এলাকা সম্প্রসারিত করল ভবিষ্যতের স্বাধীনতার কথা ভেবে। শিয়া-সুন্নির দ্বিমুখী লড়াইয়ে বিপর্যস্ত ইরাক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কুর্দিদের স্বাধীনতা ঘোষণার বিলম্ব কৌশলগত সুবিধা গ্রহণের অপেক্ষা ছাড়া আর কিছু নয়। ইরাকের শিয়া নিয়ন্ত্রিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী নুর ই মালিকি তার সরকারি বাহিনী দিয়ে কোনোভাবেই জঙ্গিদের প্রতিরোধ করতে সমর্থ হচ্ছে না। সেনারা অস্ত্র-গোলাবারুদ থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধ করছে না বলে ইতিমধ্যে চারজন সামরিক কমান্ডারকে বরখাস্ত করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নুর ই মালিকির শিয়াপ্রীতি ও সুন্নি বৈরিতা জাতিগতভাবে ইরাককে বিভক্ত করেছে মারাত্মক ভাবে। সেইসঙ্গে সাদ্দাম অনুগতদের প্রতি নিষ্পেষণমূলক নীতি বিভক্তিকে আরও পোক্ত করেছে। এই জাতিগত বিভাজন সৃষ্টি করাই ছিল সাদ্দাম পরবর্তী ইরাকে আল কায়েদার লালিত স্বপ্ন। শিয়া-সুন্নি জাতিগত সংঘাতই আল কায়েদাকে জায়গা তৈরি করে দেবে ইরাকের সংখ্যালঘু সুন্নিদের মধ্যে_ এই স্ট্রাটেজি নিয়ে এগিয়েছে আল কায়েদা এবং সার্থক হয়েছে।
সাদ্দামের সময় আল কায়েদা ইরাকে কোনো জায়গা করতে পারেনি, যদিও ইরাকে সামরিক অভিযানের যুক্তি হিসেবে ইঙ্গ-মার্কিনিরা সাদ্দামের বিরুদ্ধে আল কায়েদা পৃষ্ঠপোষকতা ও গণবিধ্বংসী অস্ত্র তৈরির অভিযোগ দাঁড় করালেও এ দুটোর সত্যতা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। ২০০৩ সালে মার্কিন দখলদারিত্বের পর আল কায়েদা ইরাকে তাদের গোপন কার্যক্রম শুরু করে 'ইসলামিক স্টেট অব ইরাক' নাম দিয়ে হয় শুরু। নির্মম ও হিংস্র প্রকৃতির নেতা মুসাব আল জারকাওয়ি ২০০৬ সালে শিয়াদের বিরুদ্ধে জাতিগত যুদ্ধ শুরু করে এবং সামারায় শিয়া ধর্মীয় মসজিদের ওপর বড় ধরনের বোমা হামলা করে শিয়া-সুন্নিদের সংঘাতকে উসকে দেয়। কিন্তু আল জারকাওয়ির নির্মম আচরণের কারণে সুন্নি উপজাতি নেতারা তাকে মেনে নিতে পারেনি এবং মার্কিন অভিযানে সে নিহত হয়। সুন্নি উপজাতি জাগরণের প্রায় ৯০ হাজার সদস্য যারা ইরাকের সন্তান নামে পরিচিত ছিল তারা আল কায়েদা জঙ্গিদের ইরাকের মাটি থেকে উৎখাত করে মার্কিনিদের সহায়তায়। ২০০৮ সালের মধ্যে সিএসআই জীর্ণশীর্ণ হয়ে অস্তিত্ব বাঁচাতে সিরিয়ার সীমান্ত পাড়ি দিয়ে উত্তর সিরিয়ার সুন্নি অধ্যুষিত অঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করে। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হলে আইএসআই নামের সঙ্গে আল শাম (সিরিয়া) যোগ করে এক অভিন্ন সুন্নি জঙ্গি গোষ্ঠীতে পরিণত হয়। আইএসআইএস অথবা কুর্দিরা এর পরিচিতি নিয়ে উত্তর সিরিয়া এবং পশ্চিম ইরাকের মরু অঞ্চলে নিজেদের সুসংহত করে। অত্যন্ত হিংস্র ও বর্বর চরিত্রের এই জঙ্গি দলটি আরব ভূমিতে ইসলামী খেলাফত স্থাপনের জিহাদি মতাদর্শ লালন করে।
মূলত তিনটি জাতিগোষ্ঠী নিয়ে ইরাক। শিয়া সম্প্রদায় সংখ্যাগরিষ্ঠ, যাদের বসবাস ইরানের সীমানাসংলগ্ন মধ্য ও দক্ষিণ ইরাকে, সুন্নি সম্প্রদায় সংখ্যালঘু হলেও ইরাকের শাসনক্ষমতা তাদের হাতেই ছিল মার্কিন আক্রমণের পূর্ব পর্যন্ত যাদের বাস উত্তর-পশ্চিম ও পশ্চিম অঞ্চলে। ইরাকের সীমানার পাশে সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলেও সুন্নিরা বাস করে যারা সিরিয়ার বাশার আল আসাদের নিষ্পেষণের শিকার। তুরস্কের সীমানাবর্তী উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কুর্দিদের বাস। কুর্দি সম্প্রদায় অনেক আগে থেকেই নিজেদের আলাদা করার লড়াই করে স্বশাসিত হয়ে কুর্দিস্তান রিজিয়নাল গভর্নমেন্ট (কেআরজি) গঠন করেছে। কুর্দিরা ইরান ও সিরিয়াতেও বাস করে। সুন্নিদের ওপর ইরাকি শিয়া সরকারের উৎপীড়ন ও অসম আচরণ ইরাককে জাতিগত ও গোষ্ঠীগত লড়াইয়ের ময়দানে রূপান্তর করেছে। মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহারের পর এই নির্যাতন বৃদ্ধি পায়। ইরানি মদদে ইরাক মার্কিন সেনাদের আইনি দায়মুক্তি দিতে অপারগতা জানালে সব মার্কিন বাহিনী চলে যায়, ফলে ইরাকের সামরিক বাহিনীর দুর্বলতা থেকেই যায়। ইরান সমর্থিত ইরাকের প্রধানমন্ত্রী নুর ই মালিকি সুন্নিদের অধিকার বঞ্চিত করে সরকার ও সামরিক বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে তাড়িয়ে দিলে শিয়া-সুন্নি বিভেদ চরম আকার পায়।
আল কায়েদাপন্থি কুর্দিরা অধিকারবঞ্চিত সুন্নিদের পুঁজি করে সংগঠনকে বাড়াতে থাকে। সুন্নি-শিয়া বিভেদ তৈরি করা আল কায়েদার কৌশলের একটি অংশ ছিল। চার বছর বুক্কা জেলে মার্কিনিদের হাতে বন্দী থেকে ২০০৯ সালে বর্তমান কুর্দি নেতা আবু বকর আল বাগদাদী মুক্তি পায় এবং আবু ওমর আল বাগদাদী ২০১০ সালে মার্কিন অভিযানে নিহত হলে সে শীর্ষ পদে বসার সুযোগ পায়। সিরিয়াতে গত তিন বছরের গৃহযুদ্ধের সুযোগ কাজে লাগিয়ে উত্তর সিরিয়ার রাক্কা প্রদেশ নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। সিরিয়ার আর একটি আল কায়েদাপন্থি জঙ্গি সংগঠন আল নুসরাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলে দুই আল কায়েদা অনুসারী জঙ্গি দলের মধ্যে লড়াই শুরু হয়। আফগানিস্তান থেকে আল জাওয়াহিরি মধ্যস্থতা করে আবু বকর আল বাগদাদীকে ইরাকে মনোনিবেশ করার পরামর্শ দিলে সে তা প্রত্যাখ্যান করলে আল জাওয়াহিরি আল কায়েদা থেকে কুর্দি গ্রুপটিকে বহিষ্কার করে। কুর্দিরা তখন থেকে আল কায়েদার খণ্ডিত অংশ হয়েই আছে।
কিন্তু কার্যত কুর্দিরা তাদের কর্মপরিধি ইরাক ও সিরিয়াজুড়ে চালাতে থাকে। প্রতিবেশী সুন্নি দেশগুলোর ব্যাপক সাহায্য পায়। ইরাকের শিয়া সরকার নুর ই মালিকি ও সিরিয়ার বাশার আল আসাদ ইরানের ক্রীড়নক হয়ে পড়ায় উদ্বিগ্ন সৌদি আরব ও তুরস্ক কৌশলগত কারণে জঙ্গিদের সমর্থন দিয়ে আসছিল। জঙ্গিদের দ্রুত সামরিক সাফল্য ও বাগদাদের উপকণ্ঠে চলে আসাটা সবাইকে চমকে দিয়েছে। কুর্দিদের সাফল্যের পেছনে যেটা সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে তা হলো : প্রধানমন্ত্রী নুর ই মালিকি সরকারের নিরঙ্কুশ শিয়াকরণ, সুন্নি নিপীড়ন, কুর্দিদের প্রতি সুন্নি উপজাতি নেতাদের সমর্থন, চাকরিচ্যুত সাদ্দাম সেনাবাহিনীর অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষিত কমান্ডার ও সেনাদের কুর্দি বাহিনীতে যোগদান, ইরানের আধিপত্য ঠেকাতে প্রতিবেশী দেশগুলোর অঘোষিত সাহায্য এবং সর্বোপরি সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ ও প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের ইরাক সীমান্তবর্তী উত্তর সিরিয়ার বিশাল এলাকায় নিয়ন্ত্রণ হারানো। কুর্দিদের সামরিক সাফল্য এক অপ্রত্যাশিত ভূরাজনৈতিক গোলকধাঁধা তৈরি করেছে। আরব বিশ্বের কেন্দ্রে আল কায়েদার অবস্থান আরব দেশগুলোকে দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আল কায়েদা জঙ্গিদের শক্তি খর্বে উদগ্রিব থাকলেও ইরানের আধিপত্য রুখতে ঠিক তেমনি তৎপর। মার্কিন বিমান আক্রমণের ক্ষেত্রে নির্লিপ্ততা তার স্বাক্ষর বহন করছে। ইরান তার সীমানার কাছে সুন্নি আল কায়েদার অবস্থান নিরাপত্তার হুমকি হিসাবে দেখছে। সৌদি-ইরান দ্বন্দ্বে ইরাকের গুরুত্ব অনেক বেশি। মধ্য ও দক্ষিণ ইরাকের শিয়া ভূমি রক্ষা করতে ইরান বদ্ধপরিকর থাকবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। শক্তি বাড়াতে গ্র্যান্ড আয়াতুল্লাহ আল সিস্তানি ইতিমধ্যেই আহ্বান জানিয়েছে শিয়া যুবকদের অস্ত্র তুলে নেওয়ার জন্য। সুন্নি জঙ্গিদের রুখতে নুর ই মালিকির নিজস্ব ক্ষমতা অনেক সীমিত হয়ে গেছে মসুল শহর দখল হওয়ার পর। কুর্দিরা মসুল কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ নিয়ে গেছে এবং ৩০ হাজার সরকারি বাহিনী ১ হাজার কুর্দি জঙ্গির আক্রমণের মুখে যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া ভারী ও উন্নত অস্ত্র গোলাবারুদ ফেলে উর্দি খুলে পালিয়ে গেছে। তারপর থেকে সুন্নিদের অগ্রাভিযান রুখতে সরকারি বাহিনীর একের পর এক ব্যর্থতা প্রমাণ করছে শিয়ারা সুন্নিদের মাটিতে নিজেদের জীবন দিতে রাজি নয়। জাতিগত যুদ্ধে শিয়াদের অনীহা নুর ই মালিকির সবচেয়ে বড় চিন্তার কারণ।
শিয়া-সুন্নির বিবাদরেখা এখন বাগদাদসহ মধ্য ইরাকে এসে ঠেকেছে। শিয়া নিয়ন্ত্রিত এলাকার পেছনে ইরান সীমান্ত, আবার সুন্নি নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের পাশে ও পেছনে রয়েছে সৌদি আরব ও তুরস্ক। সুন্নি-শিয়াদের সংঘাত জাতিগত পার্থক্যকে এত গভীর করেছে যা সহসা দূর হয়ে পুনর্মিলনের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কুর্দিরা এই সংঘাতকে উসকে দিয়ে সুন্নিদের মধ্যে তাদের অবস্থান সুসংহত করার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর সিরিয়ার ভূমধ্যসাগরের তীর থেকে শুরু করে বাগদাদের উপকণ্ঠ পর্যন্ত সুন্নিদের নতুন দেশ গঠনের উদ্দেশ্য আরবের ১৯১৬ সালের ব্রিটিশ ও ফ্রান্সের সমঝোতার ইতি ঘটিয়ে নতুন ম্যাপ তৈরিতে ব্যস্ত। যুদ্ধরত শিয়া-সুন্নিদের অচলাবস্থার মাঝে তুরস্কের সহায়তায় ইরাকের কুর্দিরা তেলসমৃদ্ধ কিরকুকসহ কুর্দি অধ্যুষিত উত্তর ইরাক অঞ্চলে স্বাধীন কুর্দিস্থান ঘোষণা শুধু সময়ের অপেক্ষায় রয়েছে। বর্তমানে কুর্দিস্থান সংঘাতমুক্ত ও স্থিতিশীল অঞ্চল যারা ইতিমধ্যে তুরস্কের বন্দর পর্যন্ত পাইপলাইন স্থাপন করে এককভাবে তেল রপ্তানি করার ঘোষণা দিয়েছে। অপরদিকে শিয়া অধ্যুষিত মধ্য ও দক্ষিণ ইরাকের তেল সম্পদের অধিকার থেকেই যাবে শিয়াদের হাতে। ইরাকের তেল সম্পদ তিন ভাগে ভাগ করে আন্তর্জাতিক বাজারে সরবরাহ করে শিয়া, সুন্নি এবং কুর্দিরা নির্ভাবনায় স্বাধীন সত্তা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবে। ইরাকের সংঘাত নিরসন ও স্থিতিশীলতা ইরাকের অখণ্ডতা বজায় রেখে সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না। অখণ্ড ইরাকের কাঠামো রাখতে হলে সব পক্ষকে একমত করতে পারলে ফেডারেল ইরাক একটি বিকল্প হতে পারে। এক্ষেত্রে ইরাকের বিবদমান তিন গোষ্ঠীর মধ্যে সমঝোতার ক্ষেত্রে প্রয়োজন সৌদি আরব, তুরস্ক ও ইরানের সদিচ্ছা ও ঐকমত্য। আল কায়েদা জঙ্গিদের উত্থান ও সামরিক সফলতা খোদ যুক্তরাষ্ট্রসহ তিন দেশের নিরাপত্তার হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে, ফলে এ ক্ষেত্রে স্বার্থের অভিন্নতা একটি যুক্ত কৌশল গ্রহণের পক্ষে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান সহযোগিতার রাস্তায় চলতে চাচ্ছে। ইরানের পরমাণু প্রকল্প সীমিত করার পশ্চিমা কৌশল ইরাক পরিস্থিতিকে তুরুপের তাস হিসেবে প্রয়োগের অপেক্ষায় রয়েছে। ইরান অতীতের বৈরিতা ভুলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের নতুন সূচনায় আগ্রহী হয়ে উঠেছে এবং পারস্য উপসাগরে মার্কিন রণতরীর অবস্থানকে সহযোগিতার পদক্ষেপ হিসেবে স্বাগত জানিয়েছে। যদিও সৌদি আরব ইরানকে কোনো ছাড় দিতে নারাজ। ইরাকের বাস্তবতা বিশ্ব কূটনীতি ও মেরুকরণের গতিধারা পরিবর্তনের চাবিকাঠিতে পরিণত হয়েছে। ইরাক, সিরিয়া, লেবাননের অভ্যন্তরীণ সমীকরণে ইরানের আধিপত্য ও ইরানের পরামাণু প্রকল্প ও ইসরায়েলের বিপক্ষে ইরানের ভূমিকাকে সীমাবদ্ধ করতে ইরাকের জাতিগত সংঘাত একটি সুযোগী পরিবেশ তৈরি করেছে। পশ্চিমা দেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলী ভূমিকা ও আল কায়েদা জঙ্গি উৎখাতে সামরিক শক্তি প্রয়োগে সতর্কতা অবলম্বন ও একইসঙ্গে শক্তি প্রয়োগের পথ খোলা রাখার হুমকি এবং জাতিগত সংঘাত নিরসনে সমঝোতার কূটনীতি চালু রাখা একটি মহাকৌশলের ইঙ্গিত। এটা পরিষ্কার যে, মহাকৌশলের উদ্দেশ্য নুর ই মালিকি শিয়া সরকারের পতন ঘটান, ইরানের আধিপত্যকে খর্ব করা, সুন্নি সম্প্রদায়ের অধিকার পুনরুদ্ধার ও ক্ষমতার অংশীদার করে তাদের ওপর আবু বকর আল বাগদাদীর কুর্দিরের নেতৃত্ব উচ্ছেদ করে মধ্যপন্থি সুন্নিদের পুনঃস্থাপন করা। ইরাকের অখণ্ডতা মার্কিনিদের কাছে যতটা না গুরুত্বপূর্ণ তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আল কায়েদা জঙ্গি দমন ও ইরানি আধিপত্য নিয়ন্ত্রণ। তাই ইরাকের অখণ্ডতা অতীতের সব সময়ের চেয়ে হুমকির মুখে। আরব ভূমিতে নতুন রাজনৈতিক ম্যাপ যেন বাস্তবতার খুব কাছে চলে এসেছে।
লেখক : সামরিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং ইনস্টিটিউট অব কনফ্লিক্ট, ল' এন্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিস (আই ক্লডস)-এর নির্বাহী পরিচালক।
Original Post at: http://www.bd-pratidin.com/2014/06/27/14067#sthash.EHlHDlYs.dpuf
No comments:
Post a Comment